রাজধানীর সোবহানবাগের বাংলাদেশ ইএনটি হাসপাতালে তিন বছর আগে অস্ত্রোপচারের রোগীর হঠাৎ অবস্থার অবনতি হয়। ২০২১ সালে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) রোগীকে রেফার করার হারও বেড়ে যায়। ওই সময় মৃত্যুও তুলনামূলকভাবে বেড়ে যায়। এ নিয়ে বোর্ড সভায় আলোচনা হয়। কারণ অনুসন্ধানে চার সদস্যের একটি অভ্যন্তরীণ তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। ওই কমিটি অনুসন্ধানে নেমে দেখে, হাসপাতালের অস্ত্রোপচার কক্ষের (ওটি) ফ্রিজারে মেয়াদোত্তীর্ণ বিভিন্ন ওষুধের ভায়াল। সেই ওষুধ অস্ত্রোপচারের রোগীর ওপর প্রয়োগ করা হতো।
গলার অস্ত্রোপচারের সময় রোগী স্বাভাবিকভাবে শ্বাস নিতে পারে না। তাই শ্বাসনালিতে এন্ডোট্র্যাকিয়াল টিউব স্থাপন করা হয়, যাতে রোগীর স্বাভাবিক শ্বাস-প্রশ্বাস ঠিক থাকে। সংবেদনশীল এসব মেডিকেল ডিভাইসের জন্য আলাদা মূল্য পরিশোধ করার পরও এক টিউব একাধিক রোগীর শ্বাসনালিতে স্থাপন করা হয়।
এখানেই থেমে থাকেনি অপকর্ম। ২০২১ সালের এক রোগীর ওষুধের বিল দেখা হয়। সেখানে দেখা যায়, দেড় হাজার টাকার কম বাজার মূল্যের ওষুধ প্রায় ৪ হাজার টাকা বিল করা হয়েছে। এভাবে রোগী ঠকাতে থাকে হাসপাতালের পরিচালনা বোর্ড।
তদন্তে আরও বেরিয়ে আসে, ওটির ফ্রিজারের সংবেদনশীল ওষুধ আর বিভিন্ন খাবার একসঙ্গে রাখা হয়েছে। ছাড়পত্র নিয়ে রোগী বাড়ি ফিরে গেলেও তার দুটি ব্লাড ব্যাগ পড়ে আছে ফ্রিজারে। মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধের ভায়ালের তথ্য আড়াল করতে ঘষামাজা করে তারিখ মুছে ফেলার চেষ্টাও হয়। সংবেদনশীল কিছু ওষুধের ভায়াল খুলে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে প্রয়োগ করার কথা থাকলেও দিনের পর দিন ওইসব ওষুধ রোগীর শরীরে প্রয়োগ করা হয়েছে। ওটিতে ব্যবহৃত গজ ও অন্যান্য মেডিকেল ডিভাইস জীবাণুমক্তকরণের জারে নেই কোনো জীবাণু প্রতিষেধকের ছিটেফোঁটা। এ নিয়ে তদন্ত কমিটির কাছে কেউ সদুত্তর দিতে পারেনি। শুধু তাই নয়, দরিদ্র রোগীর বিনামূল্যে সেবাও বন্ধ করে দেন হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি)।
এসব তথ্য উঠে আসে হাসপাতালের রোগীদের মৃত্যুহার বেড়ে যাওয়া এবং আইসিইউতে স্থানান্তরের ঘটনা তদন্তে। ডা. এম এ জলিল, অধ্যাপক ডা. এ কে এম আজিজুল হক, ডা. মো. আব্দুল্লাহ আল হারুন এবং ডা. মুহাম্মদ সাইফুল ইসলাম সাইফের তদন্ত কমিটি ২০২২ সালের ৫ জানুয়ারি বৈঠকে যেসব প্রমাণ উপস্থাপন ও সুপারিশ করা হয়, ওইসব আমলে নেননি প্রতিষ্ঠানটির এমডি ডা. জিল্লুর রহমান ও তার সিন্ডিকেট। নিজেদের খেয়াল খুশিমতো পরিচালনা করতে থাকেন হাসপাতালটি।
গত দুই সপ্তাহ ধরে সরেজমিন রাজধানীর সোবহানবাগের বাংলাদেশ ইএনটি হাসপাতাল ঘুরে এসব তথ্যের প্রমাণও মেলে। প্রতিষ্ঠানটির একাধিক চিকিৎসক, নার্স ও কর্মকর্তা তিন বছর আগের ঘটে যাওয়া ওই ঘটনার বর্ণনাও দিয়েছেন। এমনকি প্রতিষ্ঠানটির এমডির বিরুদ্ধে আরও বেশকিছু অভিযোগ তুলে ধরেন তারা। তবে সিসিটিভি ফুটেজের ভয়ে প্রতিষ্ঠানের ভেতরে কেউ এ নিয়ে মুখ খুলতে রাজি নন।
অনুসন্ধানে জানা যায়, রোগীদের সঙ্গে প্রতারণার পর আলামত মুছে ফেলতে নানান কৌশল নেয় ডা. জিল্লুর রহমান সিন্ডিকেট। বিভিন্ন ভুয়া-বিল ভাউচারে সরিয়ে ফেলা হয় ৩ কোটি ৬৭ লাখ টাকা। এ নিয়ে সন্দেহ হয় কয়েকজন পরিচালকের। তোপের মুখে স্বতন্ত্র একটি নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে নিরীক্ষা করে দেখা যায় হাসপাতালের ৩ কোটি ৬৭ লাখ টাকার হিসাবের গরমিল। এ নিয়ে কথা বলতে গেলে ডা. জিল্লুর রহমান তখন আওয়ামীপন্থি চিকিৎসকদের সংগঠন স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) সভাপতিকে দিয়ে পরিচালকদের কণ্ঠরোধ করেন।
সুত্রঃ কালবেলা