কিছুতেই নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না শব্দদূষণ
রাজধানীতে শব্দদূষণ বাড়ছেই। কিছুতেই নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না শব্দদূষণ, যা নীরব ঘাতকে পরিণত হয়েছে। রাজধানীর ডেমরা, যাত্রাবাড়ী, কদমতলী, সূত্রাপুর, গুলিস্তান, সায়েদাবাদ—এসব এলাকায় সবচেয়ে বেশি শব্দদূষণ হচ্ছে বলে জানা গেছে। সরেজমিন এসব এলাকায় দেখা গেছে, উচ্চ শব্দে গাড়ির হর্ন অযথাই বাজানো হচ্ছে। উচ্চমাত্রায় হর্ন বাজানোর কারণে সবচেয়ে বেশি সমস্যা হচ্ছে শিশু, বৃদ্ধ এবং রোগীদের।
পাড়া-মহল্লার ভেতরে এবং অলিগলিগুলোতে, বিয়েবাড়িসহ রাজনৈতিক, সামাজিক অনুষ্ঠানে উচ্চ স্বরে মাইক অথবা সাউন্ড বক্স বাজানো হচ্ছে। শব্দদূষণ ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। লোকজন অতিষ্ঠ হয়ে উঠছে। এসব বিষয়ে কেউ কিছু বলতে পারছে না। ঢাকায় শব্দদূষণের মাত্রা ১৩০ ডেসিবেলের ওপরে যেখানে ৮০ ডেসিবেলের বেশি হলেই বধির হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
দেখা গেছে, প্রতিদিন কোনো না কোনো স্থানে মাইক, পটকাবাজি, ডিজেলচালিত জেনারেটর, মিছিল, মিটিংয়ে, স্লোগান চলছে। আবাসিক এলাকাগুলোতে সনাতনী পদ্ধতি ব্যবহার করা পাইলিং মেশিনের আওয়াজে মাত্রাতিরিক্ত শব্দদূষণ হচ্ছে। এসব কারণে সুস্থ মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়ছে। শব্দদূষণ সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে অর্থদণ্ড ও কারাদণ্ডের বিধান থাকলেও সংশ্লিষ্টরা কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না তাদের বিরুদ্ধে।
মোটরযান অধ্যাদেশ ১৯৮৩ এর ১৩৯ এবং ১৪০ নং ধারায় হর্ন ব্যবহার আদেশ অমান্য করার শাস্তি হিসেবে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড বিধান রয়েছে। ২০০৬ সালের পরিবেশ ও বন সংরক্ষণ আইনের শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা অনুযায়ী নীরব এলাকায় ভোর ৬টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত দিনে ৫০ এবং রাতে ৪০ ডেসিবেল, আবাসিক এলাকায় দিনে ৫৫ এবং রাতে ৪৫ ডেসিবেল, শিল্প এলাকায় দিনে ৭৫ ও রাতে ৭০ ডেসিবেলের মধ্যে শব্দের মাত্রা থাকা বাঞ্ছনীয়।
এই আইন অনুযায়ী হাসপাতাল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সরকার নির্ধারিত কিছু প্রতিষ্ঠান থেকে ১০০ মিটার পর্যন্ত বিস্তৃত এলাকা নীরব এলাকা চিহ্নিত করা হয়। শুধু নির্দিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমোদন সাপেক্ষে আবাসিক এলাকায় শব্দের মান মাত্রা অতিক্রমকারী যন্ত্রের ব্যবহার করা গেলেও সর্বত্রই নিত্যদিন অবাধে চলছে শব্দ দূষণকারী যন্ত্রের ব্যবহার। নিয়ন্ত্রণহীনভাবে শব্দ দূষণ চলার ফলে জনসাধারণ সাময়িক বা স্থায়ীভাবে বধির হওয়ার দিকে ধাবিত হচ্ছে। এক্ষেত্রে শিশু-কিশোররা রয়েছে সর্বোচ্চ ঝুঁকিতে।
শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ আইন ২০০৬-এ বলা হয়েছে, আবাসিক এলাকার সীমানা থেকে ৫০০ মিটারের মধ্যে নির্মাণ কাজের ইট বা পাথর ভাঙার যন্ত্র ব্যবহার করা যাবে না। যানবাহনে অপ্রয়োজনে উচ্চ শব্দে হর্ন বাজানো যাবে না। যত্রতত্র গাড়ি পার্কিং করা যাবে না। এই বিধির আওতায় স্কুল-কলেজ, হাসপাতাল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালতকে নীরব এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। বলা হয়েছে, কোন উৎসব, সামাজিক বা রাজনৈতিক অনুষ্ঠানে লাউড স্পিকার, অ্যামপ্লিফায়ার বা কোন যান্ত্রিক কৌশল ব্যবহার করতে হলে কর্তৃপক্ষের পূর্বানুমতি লাগবে। এসব কার্যক্রম সর্বোচ্চ পাঁচ ঘণ্টার বেশি হবে না। পাশাপাশি রাত ১০টার পর কোনভাবেই শব্দ দূষণকারী যন্ত্র ব্যবহার করা যাবে না। কিন্তু এসব নিয়মের কোনোটাই মানা হয় না বলে জানান ভুক্তভোগীরা।
যাত্রাবাড়ী এলাকার সমাজকর্মীর মাহবুবুর রহমান ভূঁইয়া বলেন, শীতকাল এলেই যেন চারদিকে শব্দের কোলাহল শুরু হয়। বিয়েবাড়িতে বড় বড় বক্স বাজিয়ে নাচ-গান চলে। সন্ধ্যা থেকে শুরু হয়। এ ছাড়া বিভিন্ন উচ্চ মাত্রার শব্দদূষণে সাধারণ মানুষ বিরক্ত বোধ করে। এ বিষয়ে কখনো পুলিশ কিংবা প্রশাসনের কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি।
যাত্রাবাড়ী প্যারামাউন্ট হাসপাতালের প্রফেসর ডা. এম এ জি ফেরদৌস বলেন, সহনীয় মাত্রার চেয়ে অতিরিক্ত শব্দ মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতির কারণ। মাত্রাতিরিক্ত শব্দদূষণে শ্রবণশক্তি লোপসহ উচ্চ রক্তচাপ, মাথাধরা, খিটখিটে মেজাজ, বিরক্ত বোধ, অনিদ্রা, হৃদ্যন্ত্রের সমস্যাসহ নানা রকম মানসিক সমস্যার সৃষ্টি হয়। তিনি আরো বলেন, শব্দদূষণে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় শিশুরা। তাদের মানসিক বিকাশের অন্তরায় শব্দদূষণ। শব্দের মাত্রা ৬০ ডেসিবেলের ওপরে হলে শ্রবণশক্তি হ্রাস পায়।